ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

‘বিসিএস ক্যাডারদের গ্রাম’ এখন পেকুয়ার দিলজানবাড়ি

চকরিয়া নিউজ ডেস্ক :: মোয়াজ্জেম হোসাইন রিমন ও তোফাজ্জল হোছাইন সুমন দুই ভাই। বাড়ি পেকুয়ার রাজাখালীর ছোট্ট গ্রাম দিলজানবাড়ি। দু’জনই ৪৩তম বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মোয়াজ্জেম হোসেন শিক্ষা ক্যাডারে আর সুমন আহম্মেদ প্রশাসন ক্যাডারে। সাবেক জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা মোজাফ্ফর আহমদের দু’ছেলেই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করল।

তাদের নিকটাত্মীয় কুলগাঁও সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক একেএম কায়েস উদ্দিন বলেন, ছোটকাল থেকেই দুই ভাই খুব মেধাবী। কঠিন পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের জোরে তারা সাফল্য অর্জন করেছে। একই ফর্মুলায় এর আগে বিসিএসে এসেছে আমার চাচাত ভাই খালেদও। তোফাজ্জল হোছাইন সুমন বলেন, মেধা, পরিশ্রম, চেষ্টা, হার না মানার মানসিকতা নিয়ে দুইভাই বিসিএস জার্নিতে লেগেই ছিলাম। সফলতাও একসঙ্গে পেলাম। মায়ের ইচ্ছে ছিল আমরা দু’জন ক্যাডার হব। এজন্য মা অনেক হাড়ভাঙা পরিশ্রমও করেছেন। আর বাবা ছিলেন সব প্রতিকূলতার বটবৃক্ষ। শুধু সুমন-রিমন নয়, এই ছোট্ট গ্রাম থেকে এর আগে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন আরও পাঁচজন। তারা হলেন- মাস্টার সালেহ আহমদের ছেলে রাসেলুল কাদের (২৮তম বিসিএস এডমিন) ও মেয়ে মাসুমা জান্নাত (৩৫তম বিসিএস এডমিন), নুরুল ইসলামের ছেলে মনসুর আলম কাদেরী (৩০তম বিসিএস পুলিশ), মাস্টার মফিজুর রহমানের মেয়ে মনোয়ারা আকতার রিফাত (৩৮তম বিসিএস পুলিশ) ও ব্যবসায়ী ছাবের আহমদের ছেলে মো. খালেদ হোসাইন (৪০তম বিসিএস শিক্ষা)। এদের মধ্যে রাসেল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে উপসচিব, মনসুর এডিশনাল এসপি, মাসুমা ইউএনও, রিফাত এএসপি ও খালেদ শিক্ষক । অন্যদিকে, মাস্টার সালেহ আহমদের ছোট ছেলে আসিফুল কাদেরও বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর। সবার একটাই কথা রাসেল-মনসুরের অনুপ্রেরণায় তারা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এই গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বারবার বিসিএস হওয়ার বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
দিলজান বাড়ির প্রথম বিসিএস ক্যাডার রাসেলুল কাদের পড়াশোনায় ছিলেন দুর্দান্ত। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তিসহ প্রত্যেকটি শ্রেণিতে প্রথম হয়ে রাজাখালী ফৈজুন্নেছা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। তবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বাধে বিপত্তি। কক্সবাজার সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধূলা, চলচ্চিত্র, গান ইত্যাদিতে অনুরক্ত হয়ে পড়ায় তিনি উচ্চমাধ্যমিকে কাক্সিক্ষত সাফল্য পেতে ব্যর্থ হন। তবুও তিনি দমে যাননি। পরে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যায়ের ইংরেজি বিভাগে। সেখানে থেকে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে প্রভাষক (ইংরেজি) হিসেবে যোগ দেন। এরপর আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে মনোনীত হয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।

রাসেল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি ভালোলাগা শুরু হয়। বাবা-মা দু’জনেই উৎসাহ দিতেন। বাবা প্রধান শিক্ষক ও মা রাজাখালী ইউনিয়ন থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম মেট্রিক পাস করা মেয়ে। প্রত্যন্ত গ্রাম দিলজান বাড়িতে পড়ালেখার অনুক‚ল পরিবেশ ও মা-বাবার কড়াকড়ি শাসনের কারণে আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।

তিনি বলেন- দাদা আবদুল কাদের মুন্সি ১৯১৯ সালের এন্ট্রান্স পাস। ছোট দাদা মৌলভী আবদুস ছালাম রাজাখালী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণাই আমার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা। গ্রামের মুরব্বিরা ধন-সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা না করে পড়ালেখার প্রতি জোর দিয়েছেন। তারই প্রমাণ দিলজানপাড়ায় এখন ৭ জন বিসিএস ক্যাডার। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে নতুন যারা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সুপরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছি আমি। আমার আশা- আগামী ১০ বছরে পেকুয়া তথা রাজাখালীর প্রতিটি গ্রাম হতে বিসিএস ক্যাডার হবে। এজন্য সবাইকে প্রকৃত পড়ালেখা করতে হবে। আমি সবসময় মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।

অন্যদিকে, দিলজান বাড়ির মেয়েদের ছেলে-মেয়েরাও বিসিএসের সাফল্য পেতে শুরু করেছে। মরহুম ফররুখ আহমেদের নাতি আওলাদুল হাসান মিনার ৪০তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, ব্যবসায়ী ছাবের আহমেদের নাতনি তানিয়া তাসকিন ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। এ বাড়িরই আরেক নাতি আবু শিহাব মোহাম্মদ ইমতিয়াজ ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। আরেক নাতি জুনায়েদ সিনিয়র সহকারী জজ, আবদুর রহমান মোহাম্মদ তামিম, সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত।

রাসেলের কথার সত্যতা মিলেছে- রাজাখালীর মৌলভীপাড়ার ব্যবসায়ী মুসলেউদ্দিনের ছেলে আরফাত উদ্দিন টিটু ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

জানা গেছে, ছোট-বড় ২৩ পরিবার নিয়ে দিলজানবাড়ি গ্রাম। এসব পরিবারে রয়েছেন ১৮ জন শিক্ষক। এসব পরিবারের আত্মীয়স্বজনসহ বর্তমানে ১৮ জন বিসিএস ক্যাডার। শুধু বিসিএস নয়, এই গ্রামের ব্যবসায়ী বজল আহমদের ছেলে ক্যাপ্টেন মিসবাহ উদ্দিন মানিক জাপানের সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন মানিকের ভাই শাহাবুদ্দীনের ছেলে মোহাম্মদ নজিব উদ্দীন বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের অফিসার ক্যাডেট, মো. নেজাম উদ্দীনের ছেলে মাসুম রিয়াদ বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডর (বিপিডিবি) সহকারী ইঞ্জিনিয়ার। মাচেন্ট মেরিন অফিসার ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মিছবাহ উদ্দীন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পড়ালেখা করে আমার এই সফলতা। বাড়িতে সম্পদের প্রাচুর্য না থাকলেও পড়ালেখার পরিবেশ ছিল খুব ভালো। বাবা-মা, বড়ভাই- বড়বোনরা সবসময় পড়ালেখার তদারকি করতেন। আমার এতটুকু আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল সেজভাই মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীনের। এছাড়া অবদান রেখেছেন জ্যাঠাত ভাই ও মাস্টার নিয়াজ মুহাম্মদ মুকুল। আল্লাহ রহমত ছিল বলেই এতদূর এসেছি। সুত্র: পূর্বকোন

পাঠকের মতামত: